চাঁদপুরের মোহনীয় মোহনায়
আমার পরিচিত কিংবা অপরিচিত কেউ কখনো আমার গ্রামের বাড়ি কোথায় জিজ্ঞেস করলেই বলতাম আমার বাড়ি চাঁদের দেশে! রকেট দিয়ে যেতে হয়। তারা বুঝে নিত আমি চাঁদপুরের কথাই বলছি। আকাশ কুসুম চিন্তা নয়, খুব সত্য একটা অনুভূতি। চাঁদপুরের গ্রামীণ সৌন্দর্য চাঁদের রূপের মতো চোখে মুখে জড়িয়ে থাকে। আমি কেবল একটা সৌন্দর্যের রূপ তুলে ধরব।
ইতিহাস-ঐতিহ্যের শহর চাঁদপুর। ব্রিটিশ আমলের শুরুর দিকে ১৭৭৯ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ জরিপকারী মেজর জেমস রেনেল তৎকালীন বাংলার যে মানচিত্র এঁকেছিলেন, তাতে চাঁদপুর নামক একটি জনপদ উল্লেখ ছিল। ব্রিটিশ শাসনকাল থেকেই চাঁদপুর তার কৃষ্টি, সংস্কৃতিতে নিজস্ব ঐতিহ্যগত সুখ্যাতি ধরে রেখেছে এখন পর্যন্ত। অনেক আগে থেকেই চাঁদপুর প্রসিদ্ধ নানা কারণে। বাংলায় বারো ভূঁইয়াদের শাসনকালে এ জনপদ ছিল বিক্রমপুরের জমিদার চাঁদরায়ের অধীনে। সেই সময় থেকেই এ জনপদ সমৃদ্ধ লাভ করে।
এখন সেই সৌন্দর্যের কথা বলব যেটি চাঁদপুর শহরকে বহু বছর লালন করে যাচ্ছে। যার নাম পদ্মা, মেঘনা ও ডাকাতিয়া নদীর মোহনা বা “মোলহেড”। এটি চাঁদপুর বড় স্টেশন থেকে অল্প দূরে। ব্যবসায়িক উন্নতির জন্য ব্রিটিশ বনিকেরা এই জেলা বেছে নিয়েছিল। ১৮৫৭ সালেই চাঁদপুর জেলায় রেললাইন স্থাপিত হয়। রেলস্টেশনের বয়স এখন প্রায় ১৬০ বছর।
ত্রিমোহনা বা মোলহেডের অবস্থান চাঁদপুর জেলা শহরের পশ্চিমাংশে। নতুন পুরাতন শহর বিভক্ত করেছে ডাকাতিয়া নদী। নাম হয়েছে নতুন বাজার ও পুরান বাজার। এই মোলহেডের যত পশ্চিমে যাওয়া যায় ছোট ছোট বালু চরের দেখা মিলবে। সবই নদীর বুকে জেগে থাকে কয়েকমাসের জন্য! তবে কিছু চর আছে স্থায়ী। চাঁদের অপূর্ব জোছনা যখন চাঁদপুরের চরের বুকে পড়ে, এক অপার্থিব দৃশ্যের সূচনা হয়।
এই মোলহেড সংলগ্ন পদ্মা-মেঘনা-ডাকাতিয়ার মিলনস্থল হলো বিশ্বজয়ী রূপালী ইলিশের উৎকৃষ্টতম প্রজনন কেন্দ্র। প্রতি বছর অসংখ্য মা ইলিশ এ মোহনায় এসে ডিম ছাড়ে। ঠিক এ কারণেই এই জায়গাকে ডাকা হয় ইলিশের বাড়ি নামে।
পুব আকাশে সূর্যের প্রথম আলোকচ্ছটা তিন নদীর মিলনস্থলে পড়ে চিকচিক করে ওঠে। রঙিন হয়ে দোল খায় ঢেউয়ের সাথে। শেষ বিকালে সুপারি গাছের ফাঁক গলে রক্তিম আভায় এ মোহনা আরেক রূপ ধারণ করে। বড় বিচিত্র আর অপূর্ব সে রূপ।
চাঁদপুর কালীবাড়ি রেলস্টেশন থেকে বড়স্টেশন বা মোলহেড পর্যন্ত পুরো রেললাইন ঘেঁষে শুয়ে আছে একটা সরু পিচ ঢালা পথ। দুপুর- বিকালের মাঝামাঝি সময়টাতে দলবেঁধে মানুষ এই পথে মোলহেডের দিকে যায়। অপূর্ব চিত্তাকর্ষক এক রূপ দেখতে ছুটে চলা যেন।
মোলহেডের প্রবেশ মুখে রয়েছে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ হওয়া বীর যোদ্ধাদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভ “রক্তধারা”। বেশ খানিকটা দূর থেকেই চোখে পড়ে এটি। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে এই শহরের পাকবাহিনীদের কয়েকটি টর্চার সেলের একটি ছিল এই বড় স্টেশন সংলগ্ন এলাকায়। অসংখ্য নারী-পুরুষ নির্যাতনের স্বীকার হয়ে এই মোলহেডে তাদের শেষ ঠিকানা হতো। নৃশংস নির্যাতনের পর জীবিত অথবা মৃত সরাসরি নিক্ষেপ করত এই মোহনায়।
মায়াবী সূর্যাস্ত দেখার আদর্শ একটি স্থান হলো মোলহেড। তিনটি নদীর পানি দূর থেকেই আলাদা করে চিনতে পারা যায় এখানে। টুকটুকে লাল সূর্যটা যখন ডুবে যায় তখন মনে হয় নদীতে যেন ছড়িয়ে গেছে রঙের স্তূপ। রং বিলাতে বিলাতে হঠাৎই হারিয়ে যায় রঙের খনিটি। তবু এর রেশ থেকে যায় অনেকক্ষণ।
স্রোতের মাতাল মধুর শব্দে মন উদাস হয়ে যাবেই। চেনাজানা পাখিদের কলকাকলিতে মুখর হয়ে যাওয়া সুপারি গাছের সৌম্য সারি এমন ভাবালুতা এনে দেয় মনের মধ্যে। দূর থেকে ভেসে আসা কোনো মাঝির হাঁক শুনলে মনে হবে এ যেন সাক্ষাৎ স্বর্গীয় ধ্বনি!
লম্বাটে ইলিশ মাছ ধরার ট্রলারের কোনোটি মাত্র ইলিশঘাটে ঢুকছে কোনোটি বা মাত্র বেরিয়ে যাচ্ছে গভীর দূর গাঙে।সবগুলো ট্রলার বেশ আয়েশিভাবে মোলহেডের বুক ভেসে সামনে এগোচ্ছে। ট্রলারগুলোর ভটভট শব্দ অনেকসময় ধরে মিলিয়ে এসে কানে সুর হয়ে তাল দিবে নতুনভাবে সুখ খোঁজার। যাত্রীবাহী লঞ্চ আধঘণ্টা পর পর পর্যটককে মুগ্ধ করে সামনে দিয়ে যেয়ে টার্মিনালে পৌঁছে। আবার শহরমুখীও হয়।
কালগর্ভে মানুষ হারিয়ে যায়, পুরনো স্মৃতি ঘষামাজার জরুরি হয়, পুরোনো দালান-স্থাপনার চুন সুরকি খসে খসে পড়ে, নদী খেয়ে ফেলে মানুষ, বাড়ি আর শহর! হ্যা, চাঁদপুর নামক এই সুন্দর জেলাটিও কত কতবার ডুবেছিল। নদীর তলদেশে হারিয়েছিল কাউকে না জানিয়ে!
বড় স্টেশন বেশ কয়েকবার নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। নদী ভাঙনের মুখে পড়ে সম্পূর্ণ শহর গিলে ফেলেছিল সর্বনাশা মেঘনা। ভাঙন অব্যাহত রেখে ২০০১ সালে পুরোপুরিভাবে বিলীন হয়েছিল বড় স্টেশন। আঞ্চলিক ভাষায় বড় স্টেশনকে “ঠোডা” নামে ডাকা হয়। এই ঠোডা বিলীন হওয়া নিয়েও প্রভুভীরু মানুষদের একটি মিথ বলতে শোনা যায়। মিথটি এমন যে একবার এক পথচারী ভিখারি একটি হোটেল থেকে খাবার চাইতে গেলে হোটেলটির এক কর্মচারী ক্ষুব্ধ হয়ে গরম তেল ছুড়ে দেয় ঐ ভিখারির গায়ে। তখন সে যন্ত্রণায় অভিশাপ দেয় যে কিছু সময়ের মধ্যে তোরা সকলে মহাপ্রলয়ে ধ্বংস হয়ে মরবি।
স্থানীয়রা ধারণা করে ঐ লোকটির নাম সাব গাজী, সে নাম অনুযায়ী বড়স্টেশনকে সাব গাজীর আস্তানাও বলে ডাকে।
বড় স্টেশন মিথ অনুযায়ী বিলীন হোক বা প্রাকৃতিক কারণে হোক। বিলীন হয়েছে তা কয়েকবারই। সেজন্য প্রশাসন শহর রক্ষাবাঁধ নামক একটি প্রকল্প অনুমোদন দেয়। সে অনুযায়ী বড় স্টেশনের তিন দিকে বিশাল বড় বড় কংক্রিটের তৈরি ব্লক বসানো হয়। যা বড়স্টেশনকে অনেকবেশি মনোরম করে তুলেছে।
প্রিয় পাঠক, আপনিও হতে পারেন আওয়ার বাংলা অনলাইনের একজন সক্রিয় অনলাইন প্রতিনিধি। আপনার আশেপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনা, অপরাধ, সংবাদ নিয়ে লিখুন এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ছবিসহ মেইল করুনঃ [email protected] এই ঠিকানায়। লেখা আপনার নামে প্রকাশ করা হবে।