ইসলামে সন্তানের অধিকার
জগত সংসারে মানুষের প্রিয়তম বস্তু ও হৃদয়ের অন্যতম আনন্দ যেমন সন্তান-সন্তানাদি, আখেরাতের জীবনেও তেমনি মানুষের সাথী ও আনন্দ এই সন্তান-সন্তানাদি। কুরআন কারীমে একাধিক স্থানেঘোষণা করা হয়েছে যে, জান্নাতে মুমিনগণ তাদের সন্তানদের সাহচর্য উপভোগ করবেন।
আল্লাহ তাআলা বলেন, যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের সন্তান-সন্তানাদি যারা ইমানের বিষয়ে তাদের অনুগামী হয়েছে, তাদের সন্তান-সন্তানাদিকে তাদের সাথে মিলিত করাব এবং তাদের কর্মফল কিছু কম করা হবে না। (সুরা তুর- ২১)
সন্তানদেরকে দুনিয়া ও আখিরাতে সত্যিকারের আনন্দের উৎস বানাতে আমাদের অনেক দায়িত্ব রয়েছে। এজন্য কুরআন ও হাদীসে সন্তানদের প্রতি পিতা-মাতার কর্তব্য ও দায়িত্ব বিশেষরুপে উল্লেখ করা হয়েছে। সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার প্রাথমিক দায়িত্বগুলোর অন্যতম হলো-
১/ জন্মের সাথে সাথে সন্তানের কানে আজান দেওয়া-
সাহাবি আবু রাফে’ রা. বলেন, আমি দেখলাম যে, ফাতিমা রা. যখন হাসানকে জন্ম দিলেন তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) হাসানের কানে নামাজের মতো আজান প্রদান করেন। (সুনানে আবুদাউদ-৪/৩২৮, সুনানে তিরমিযী- ৪/১৭)
২/ তাহনিক করা ও নাম রাখা-
আমাদের সমাজে সন্তানদের “ভাতমুখে” দেওয়ার রীতি আছে। তা ইসলামী রীতি নয়। ইসলামে যে রীতি নবী (সা.) প্রচলন করেছেন তা হলো নবজাতক শিশুর জন্মের কয়েকদিনের মধ্যে কোনো নেককার বুজুর্গের (দাদা, দাদি, নানা, নানি, ইমাম) নিকটে নিয়ে শিশুর মুখের মধ্যে চিবানো খেজুর বা মধু বা অনুরূপ কোনো মিষ্টি খাদ্য দ্রব্য ছোঁয়ানো। একে তাহনীক বলা হয়।
সাহাবী আবু মুসা আশ-আরী রা. বলেন, আমার একটি পুত্র সন্তান জন্মালে আমি তাকে নিয়ে নাবী (সা.) এর কাছে গেলাম। তিনি তার নাম রাখলেন ইব্রাহীম। অতপর খেজুর চিবিয়ে তার মুখে দিলেন এবং তার জন্য দু’আ করে আমার কাছে ফিরিয়ে দিলেন। (সহীহ বুখারী হা- ৭১/১-৫৪৬৭)
৩/ আকিকা করা-
জন্মের ৭ম দিনে নবজাতকের শরীরের ময়লা পরিষ্কার করা, চুল কাটা, চুলের ওজনের সমপরিমাণ রৌপ্য দান করা এবং তার পক্ষ হতে মেষ বা ছাগল আকিকা হিসেবে জবেহ করা। কেননা- নবী (সা.) বলেছেন, প্রত্যেক শিশু তার আকীকার বিনিময়ে বন্ধক থাকে। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস- ২১/২৮৩৮)
উম্মে কুরয রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, আকিকা ছেলের পক্ষ থেকে সমবয়স্ক দুটি বকরী এবং মেয়ের পক্ষ থেকে একটি বকরী জবেহ করতে হবে। ( সুনানে আবুদাউদ হাদিস- ২১/২৮৩৬)
নবজাতক ছেলে সন্তানের পক্ষ হতে একটি করে বকরী আকীকা করা যাবে। সাহাবী ইরনু আব্বাস রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) হাসান ও হুসাইন রা. পক্ষ থেকে একটি করে বকরী আকীকা করেন। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস- ২১/২৮৪১)
৪/ খতনা করানো-
ইবনে আব্বাস রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) হাসান ও হুসাইনের জন্য তাদের আকিকা করেন এবং সপ্তম দিনে খতনা করান। (বাইহাকী শুআবুল ঈমান- ৬/৩৯৪)
৫/ দুধপান করানো-
মাতার ওপর দায়িত্ব হলো দু’ বছর সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ানো। আর পিতার দায়িত্ব হলো মাতার জন্য এরূপ দুগ্ধদানের যথাযোগ্য ব্যবস্থা করা। ছয় মাস বয়স থেকেই শিশুকে অন্যান্য (শক্ত ও নরম মিশ্রিত) খাদ্য গ্রহণে অভ্যস্ত করতে হবে যেন দু’বছরের মধ্যে তাকে বুকের দুধ খাওয়ানো বন্ধ করা যায়, কেননা আল্লাহ তাআলা বলেন, “যে সকল মায়েরা, দুধপান করানোর সময়টি পূর্ণ করতে চায়, তারা তাদের সন্তানদেরকে পূর্ণ দু’বছর বুকের দুধ খাওয়াবে আর পিতার ওপর দায়িত্ব হলো যথাবিধি তাদের (মা ও শিশুর) ভরণপোষণ করা।” (সূরা বাকারা- ২৩৩)
৬/ সৎ সন্তান গড়া-
মহান আল্লাহ তাআলা বলেন, “হে বিশ্বাসীগণ! তোমারা নিজেদেরকে এবং পরিবারকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা কর।” (সূরা তাহরীম- ৬)
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “তোমাদের সন্তানদের বয়স ৭ বছর হলে তাদেরকে নামাজ আদায়ের আদেশ কর। আর ১০ বছর বয়স হলে তাদেরকে শাসন করবে এবং তাদের বিছানা পৃথক করে দিবে।” (সুনানে আবু দাউদ- ১/১৩৩)
সন্তানদেরকে দৈহিক, আত্মিক, মানসিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী, স্বাবলম্বী ও সম্মানিত রুপে গড়ে তোলা পিতা-মাতার মূল দায়িত্ব। প্রথম যে বিষয়টি সন্তানদের মাঝে গড়ে তুলতে হবে তা হলো সততা ও ধার্মিকতা। তারা ইসলামের সঠিক বিশ্বাস, কর্ম ও আচরণ শিখবে ও পালন করবে। স্বার্থপরতা, ধোঁকাবাজী, মুনাফিকী, বক-ধার্মিকতা সৃষ্টি, অকল্যাণ ইত্যাদি যে সকল বিষয় আল্লাহ তাআলা নিষেধ করেছেন তা ঘৃণা করাবে এবং বর্জন করবে।
৭/ কর্মঠ সন্তান গড়া-
সন্তান প্রতিপালনের ক্ষেত্রে অন্যতম বিষয় হলো তাদেরকে শক্তিশালী রূপে গড়তে হবে। ঈমানের শক্তি, মনের শক্তি, দেহের শক্তি সকল দিক থেকেই শক্তিশালী হয়ে গড়ে উঠবে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, শক্তিশালী মুমিন আল্লাহর কাছে দূর্বল মুমিনের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর ও প্রিয়তর। (সহীহ মুসলিম- ৪/২০৫২)
৮/ খেলাধুলা-
সন্তানদের দৈহিক ও মানসিক বিকাশ ও শক্তি অর্জনের জন্য তাদের শরীর চর্চামূলক খেলাধুলা করাতে ইসলামে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। বিশেষত তীর নিক্ষেপ, ঘোড়ার পিঠে আরোহণ, সাঁতার ইত্যাদি খেলাধুলা বিশেষভাবে নবী (সা.) ও সাহাবীগণ করতেন।
আয়েশা (রা.) বলেন, হাবশীগণ (ইথিওপিয়াবাসী) লাঠি, বল্লম, বর্শা ইত্যাদি নিয়ে খেলা করছিল। উমর (রা.) তাদের এই খেলায় আপত্তি করলে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, “উমর! তুমি ওদের খেলতে দাও।” এরপর নবী (সা.) ক্রীড়ায়তদেরকে বলেন, “হে হাবশিগণ! তোমরা খেল, যেন ইহুদি খ্রিস্ট্রানরা জানতে পারে যে, আমাদের ধর্মের মধ্যে প্রশস্ততা আছে। আমি প্রশস্ত দ্বীনে ন্যায়বরণকারীসহ প্রেরিত হয়েছি।” (সহীহ বুখারী- ১/৩২৩, ৩৩৫, সহীহ মুসলিম- ২/৬০৯)
সাহাবি উকবা বিন আমীর (রা.) বলেন, “রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমরা তীর নিক্ষেপ কর এবং ঘোড়ায় আরোহণ কর, ঘোড়ায় আরোহণ করার চেয়ে তীর নিক্ষেপ করা আমার নিকট বেশি প্রিয়। (সুনানে তিরমিযী- ২/১৭৪, সুনানে নাসায়ী- ৬/২২২)
৯/ স্বচ্ছলতা প্রদান করা-
সন্তানদের অর্থনৈতিক শক্তি স্বচ্ছলতার বিষয় রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, “তাদেরকে (সন্তানদেরকে) মানুষের দয়ার মুখাপেক্ষী রেখে যাওয়ার চেয়ে তুমি তোমার উত্তরাধিকারীদের স্বচ্ছল রেখে যাবে সেটাই উত্তম। (সহহি বুখারী- ১/৪৩৫, সহহি মুসলিম- ৩/১২৫১)
উল্লেখ্য যে, মনই মানুষের নিয়ন্ত্রক। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো আত্মিক ও মানসিক দিক থেকে সন্তানদের শক্তিশালী রূপে গড়ে তোলা। দৈহিক শক্তির সাথে সাথে মানসিক শক্তি ও স্থিতি আরও বেশি প্রয়োজনীয়। তাই মুসলিম সমাজের পিতা-মাতাদেরকে নিজ সন্তানদের মানসিক বিকাশের দিকে লক্ষ্য রাখা জরুরী।
১০/ বন্ধু মনোভাবাপন্ন হওয়া-
অধিকাংশ ক্ষেত্রে পিতা-মাতা নিজেদের কর্ম, বন্ধুত্ব ও সামাজিকতা নিয়ে এত ব্যস্ত থাকেন যে, সন্তানদেরকে সময় দিতে পারেন না, অথচ পিতা-মাতার সময় ও বন্ধুত্বের সবচেয়ে বেশি অধিকারী সন্তানগণ। প্রতিদিন তাদের কিছু সময় দেওয়া, তাদের মনের কথা ও সমস্যাগুলো জানা ও সমাধান দেওয়া, তাদের সাথে নিয়মিত কিছু সময় ইসলামসম্মত চিত্ত বিনোদন ও খেলাধুলায় সময় কাটানো পিতা-মাতার দায়িত্ব।
রাসূলুল্লাহ (সা.) আয়েশা রা. কে বলেন, হে আয়েশা! তুমি কোমল হও, বন্ধুভাবাপন্ন হও। কারণ আল্লাহ যদি কোনো পরিবারের কল্যাণ চান তাহলে তাদেরকে কোমলতা ও বন্ধুভাবাপন্নতা দান করেন। (সহীহুত তারগীব- ৩/১১, মুসনাদে আহমদ- ৬/১০৪, ১১২)
বারাআ রা. বলেন, আমি নবী (সা.) কে দেখেছি যে, হাসান রা. তাঁর কাঁধে বসা অবস্থায় তিনি বলেছেন, “হে আল্লাহ! আমি একে ভালবাসি। অতএব তুমিও তাঁকে ভালবাসো।” (আল আদাবুল সুফরাদ- ৪৬/৮৫)
নুমাইর ইবনে আওস রহ. বলেন, প্রবীণ সাহাবীগণ বলতেন, সততা ও যোগ্যতা আল্লাহর দান এবং
শিষ্টাচার পিতৃপুরুষের দান। (আল আদাবুল মুফরাদ- ৫১/৯১)
১১/ মুখমন্ডলে আঘাত না করা-
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, “তোমাদের কেউ তার খাদেমকে শাসন করলে সে যেন তার মুখমন্ডলে আঘাত না করে।” (আল আদাবুল মুফরাদ- ৯২/১৭৩)
অতএব যেমনিভাবে খাদেমদেরকে শাসনকালে মুখমন্ডলে আঘাত করতে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে, তেমনি নিজ সন্তানদেরকেও শাসনকালে তাদের মুখমন্ডলে কোনো অবস্থাতে আঘাত (চড়, থাপ্পর মারা) করা নিষেধ।
আনাস রা. বলেন, সন্তান-সন্ততি ও পরিবারের সদস্যদের প্রতি স্নেহ, দয়া ও মমতা করার ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর চেয়ে বেশি কাউকে আমি দেখিনি। (সহীহ মুসলিম- ৪/১৮০৮)
১২/ বিবাহ কার্য সম্পাদন করা-
বর্তমানে আমাদের সমাজে বয়ঃপ্রাপ্ত সন্তানদেরকে সমাজের উঁচু অবস্থানে পৌঁছানোর অযুহাত দেখিয়ে অভিভাবকগণ তাদের নিজ সন্তানদের বিবাহ কার্য সম্পাদন করান না। কিন্তু এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (সা.) কঠোরভাবে সতর্ক করেছেন।
আবু সাঈদ ও ইবনু আব্বাস রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তির কোনো সন্তান (ছেলে বা মেয়ে) জন্মগ্রহণ করে, সে যেন তার উত্তম নাম রাখে, আর উত্তম আচার-আচরণ শিক্ষা দেয় এবং যখন সেই সন্তান বয়ঃপ্রাপ্ত হয় তখন যেন বিয়ে দেয়। বয়ঃপ্রপ্তির পর যদি বিয়ে না দেয় এবং ঐ সন্তান যদি কোনো পাপ করে (ব্যাভিচারের মত পাপ করে) তবে ঐ পাপের বোঝা পিতার উপর বর্তাবে। (মিশকাত- ১৩/৩১৩৮)
অতএব সন্তানদেরকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টার সাথে সাথে যথা সময়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করানোর প্রতি মনোনিবেশ করা ফরজে আইন বা সার্বজনীন ফরজ।
১৩/ মমতা বজায় রাখা-
স্নেহ-মমতা, উপহার, উপঢৌকন ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে সকল সন্তানের মধ্যে সমতা বজায় রাখতে হবে। কোনো সন্তানকে অন্যান্য সন্তান থেকে পৃথকভাবে অতিরিক্ত স্নেহ করা বা পুত্রদের বেশি স্নেহ আর কন্যাদের কম স্নেহ করা ইসলামে কঠিনভাবে নিষেধ করা হয়েছে।
নো’মান ইবনু বাশীর রা. বলেন, তার পিতা তাকে নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর কাছে এসে বলেন, আমি আমার ছেলেকে একটি খাদেম দান করেছি। তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, তোমার সকল সন্তানকেই কি তুমি এরুপ দান করেছো? তিনি বলেন, না। তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, এটি ফিরিয়ে নাও। (সহীহ মুসলিম- ৩/১২৪১-৪২)
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “তোমাদের সন্তানদের মধ্যে সমতা বজায় রাখবে।” (সুনানে আবু দাউদ- ৩/২৯৩)
আল্লাহ আমাদেরকে সন্তান-সন্তানাদিদের সাথে ইসলামী অনুশাসন অনুযায়ী শিষ্টাচার পালন করার তওফিক দান করুন। আমিন।
প্রিয় পাঠক, আপনিও হতে পারেন আওয়ার বাংলা অনলাইনের একজন অনলাইন প্রতিনিধি। ইসলাম বিভাগে যেকোন তথ্য, প্রতিবেদন, গবেষণা, মাসালা এবং অলোচনা নিয়ে লিখুন আমাদের কাছে। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ছবিসহ মেইল করুনঃ [email protected] এই ঠিকানায়। লেখা আপনার নামে প্রকাশ করা হবে।