পরাজিত মানুষের পাশে কেউ হাটে না
পরাজিত মানুষের পাশে কেউ হাটে না। মানুষ চিরকাল বিজয়ীর গুণকীর্তন করে। বরণ করে। তাই পরাজিতের কোন ইতিহাস নেই। কাল মন্ত্রীসভা গঠন হবার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে সবচেয়ে বেশি ট্রল হয়েছে নৌ-মন্ত্রী শাহজাহান খান আর নুরুল ইসলাম নাহিদকে নিয়ে। কিছু দৃষ্টিকটু ছিল। ছিল কিছু অম্ল মধুর ট্রল, “মনে রবে কিনা রবে আমারে?”
শাহজাহান খান নিয়ে আমার বলার কিছু নাই। ঐতিহ্যবাহী সিলেট এমসি কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র নুরুল ইসলাম নাহিদের রাজনৈতিক জীবন বাম ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী হিসেবে শুরু। আইয়ুব বিরোধী ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে একজন ছাত্র নেতা হিসেবে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সত্তরে ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি নির্বাচিত হন।
৭৬-এ হন যুব ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। নব্বইয়ে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে রাখেন গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা। ৯১-এ হন সিপিবির সাধারণ সম্পাদক। তারপর যোগ দেন আওয়ামী লীগে। ৯৬-এ সিলেট-৬(বিয়ানীবাজার-গোলাপগঞ্জ) থেকে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ হারলে বিএনপি জমানায় বিরোধী দলের রাজনীতির পাশাপাশি নিয়মিত পত্রিকায় কলাম লিখতেন। ’যুগান্তর’ পত্রিকা নতুন বের হয়েছে। সম্ভবত উনি তখন দলের শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক। উনার কলামগুলোতে তাই শিক্ষা ভাবনার আধিক্য থাকত। একজন পাঠক হিসেবে মনযোগ দিয়ে পড়তাম। উনাকে প্রথম দেখি শাহবাগ আজিজ সুপার মার্কেটে প্রকাশক সেলিম ভাইয়ের অফিসে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে সবেমাত্র ভর্তি হয়েছি। আঁতেলদের আস্তানা আজিজ মার্কেটের অনেক গল্প শোনা। ওদিকে তাই মাঝেমধ্যে যাই। বইয়ের দোকান ইতোমধ্যে সব সাফ হয়ে গেছে। দুএকটা কালের সাক্ষী হয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরছে বা আছে। আজিজ তখন বুটিক শপিং সেন্টার হিসেবে নাম করছে। সেলিম ভাই তাঁর অফিসে একদিন নুরুল ইসলাম নাহিদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। হাফ হাতা ফতুয়া পরা একজন সাদামাটা মানুষ। দেখলে মফস্বলের কোন আদর্শ স্কুল শিক্ষকের চেহারা মনে পড়ে। যা হোক, সেদিন উনার সঙ্গে আলাপ পরিচয় হয়। পরে ক্যাম্পাসে আরও দু’একবার নানা উপলক্ষ্যে দেখা হয়। আলাপ হয়।
১/১১ পরবর্তী দেশে ছায়া সামরিক শাসন চলছে। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে রাজপথে আন্দোলন শেষে ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচন করে ক্যাম্পাসে ফিরেছি। উনি তখন নতুন সরকারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হয়েছেন। এমন সময় একদিন ছুটি কাটিয়ে বাড়ি থেকে ফিরছি। ক্যাম্পাস জীবনের প্রথম দিককার সময়। আবেগে টইটুম্বুর বয়স। সিলেট থেকে সায়েদাবাদে বাস পৌঁছানোর কথা রাত এগারোটা বড়জোর বারোটার মধ্যে। তীব্র জ্যামে আটকে বাস পৌঁছেছে মাঝরাতে। দুইটার দিকে। তখনও ঢাকা শহর অতো ভালো চেনাজানা হয়ে ওঠেনি। গভীর নির্জন রাত। অচিন শহরে নিজেকে একটু অসহায়ই লাগছিল। বাসে বসে বসে এইসব জ্যাম, বিড়ম্বনা, ভোগান্তি, মানুষের অসহায়বোধ—এইসব হাবিজাবি লিখে মন্ত্রীর সেল ফোনে একটা টেক্সট করি। তরুণরা জঞ্জালে ভরা এই দেশ নিয়ে কিভাবে স্বপ্ন দেখবে যদি নতুন সরকার এসব কিছু না বদলায়? সায়েদাবাদে বাস থেকে নেমেই দেখি রাত আড়াইটার সময় উনার ফোন। বুক ধক করে উঠল। নিশ্চয়ই এত রাতে বিরক্ত করার জন্য বকাঝকা দেবেন। প্রথম কল তাই আর ধরিনি। দ্বিতীয়বার ফের কল। এবার রিসিভ না করে পারলাম না। –“আলমগীর, এখন তুমি কোথায়? কিভাবে হেল্প করতে পারি বল?” বিস্মিত আমি শুধু বললাম স্যার কোন হেল্প লাগবে না। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। তারপর দেশ বদলাবে। তরুণদের এ দেশ নিয়ে আশাবাদী হতে হবে। পরিবর্তনের জন্য ধৈর্য্য ও আস্থা রাখতে হবে। এরকম আরও কিছু কথা সেই মাঝরাতে বলেছিলেন—এখনও মনে আছে।
উনার সঙ্গে পরে আমার আর তেমন যোগাযোগ হয়নি। ব্যস্ত ও বিশাল মন্ত্রণালয়। কোনদিন কোন কাজে, তদবিরে উনার মন্ত্রণালয়েও যাইনি। উল্টো প্রশ্নফাঁস আমলে চরম সমালোচনা করে উনার বিরুদ্ধে লিখেছি। সে লেখা রীতিমতো অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোতে ভাইরাল হয়েছিল। গতকাল মন্ত্রীসভায় কাদের দেখতে চাই এরকম একটা ফেসবুক স্ট্যাটাস লিখি। সিলেট অঞ্চল থেকে উনার নামও নিইনি। যা হোক, আজ বলতে ইচ্ছে করছে এই যে ডিজিটাল যুগে প্রশ্নফাঁসের জন্য চরম সমালোচিত হলেন নাহিদ—এর দায়ভার কী পুরোটা উনার একার? আমাদের কারোর কোন দায় নেই? সমাজের নেই? —পুরো রুগ্ন একটি সমাজ। নৈতিক অবক্ষয়, সামাজিক মূল্যবোধের চরম ধস নেমেছে। পরিবর্তনশীল যুগে নানাকারণে। খোদ শিক্ষকদের একটা বড় অংশ যেখানে কোচিং ব্যবসা, রাজনীতি, প্রশ্নফাঁস চক্রের সঙ্গে জড়িত, জড়িত অভিভাবকেরাও—সেখানে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের প্রধান হিসেবে এই মানুষটার দায় আছে। কিন্তু তিনিই একমাত্র দায়ী নন।
এই যে ৩৫ কোটির বেশি নতুন বই বছরের প্রথম দিন বিতরণ আওয়ামী লীগ সরকার তার বিরাট সাফল্য বলে প্রচার করল–এই সাফল্যের কী তিনি সবচেয়ে বড় অংশীদার নন? তাঁর আমলেই দ্রুত যুগোপযোগী একটি শিক্ষানীতি-২০১০ প্রনয়ণ করা হয়। তাঁর আমলেই প্রযুক্তি প্রভাবিত পৃথিবীতে দেশে আইসিটি শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটে। এক সময়ের রহস্যাবৃত্ত মাদ্রাসা শিক্ষার আধুনিকায়ন কী তাঁর অন্যতম যুগান্তকারী পদক্ষেপ নয়? শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রসার, ব্যাপক অবকাঠামোগত উন্নয়ন(মনে করে দেখুন ১৫/২০ বছর আগে কিরকম প্রতিষ্ঠানে আপনি আমি যেতাম, আর এখন কেমন), সরকারিকরণ ও দেশের লাখ লাখ শিক্ষকদের বেতন, বোনাস ও সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি, প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত দেশের লাখ লাখ শিক্ষার্থীদের জন্য উপবৃত্তি প্রদানের মত অনন্য কর্মসূচি চালু—সরকারের পাশাপাশি তাঁর আন্তরিক সদিচ্ছারই প্রতিফলন কী নয়? পাঠ্যপুস্তকে জাতীর মুক্তি সংগ্রামের সঠিক ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির আলোকে মননশীল, যুক্তিবাদী, অন্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, পরমতসহিষ্ণু, অসাম্প্রদায়িক, দেশপ্রেমিক, কর্মকুশল ও যুগোপযোগী জ্ঞানভাবনায় সমৃদ্ধ দেশপ্রেমিক নাগরিক তৈরিতে উপযোগী নতুন টেক্সট বই তো তাঁর আমলেই রচিত হয়েছে।
পীর ফকিরের মাজেজায় বিশ্বাসী মানুষের দেশে একজন মানুষের কাছেই আমরা সকল রোগের উপশম খুঁজি। একজন নুরুল ইসলাম নাহিদ পীর নন, একজন রক্ত মাংশের মানুষ ছিলেন। তাকে এভাবেই দেখা উচিত। সাফল্য ব্যর্থতা মিলিয়েই মানুষ। যা হোক, পরাজিত ও পদহীন মানুষকে নিয়ে এদেশে কেউ লিখে না। ফুলের সৌরভে ভরা তোড়া দেয় না। এমননকি ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে যারা তাঁর কাছ থেকে সুবিধাভোগী তারাও না। তাই আজ তাঁর জন্য দু’কথা লিখতে ইচ্ছে হল। নানা সীমাবদ্ধতার জন্য তাঁর দায়িত্বে তিনি হয়ত পুরোপুরি সফল ছিলেন না। চিন্তারুগ্ন মানুষের দেশে সদিচ্ছা থাকার পরও পেরে উঠেননি। তবুও ব্যক্তিগতভাবে মনে করি শেখ হাসিনা সরকারের মন্ত্রীসভায় যে কজন মন্ত্রী সৎ ও নিষ্ঠাবান ছিলেন—তিনি তাদের অন্যতম। গতকাল যারা নতুন দায়িত্ব নিয়েছেন তাঁরাও যোগ্য। কিন্তু রাতারাতি এই দুষ্টচক্র থেকে তাঁরা জাতিকে উদ্ধার করবেন—এমন প্রত্যাশা না করাই ভালো। তবে আশা করতে পারি, ধীরে ধীরে পরিবর্তন আসবেই।