ধুলাই জীবন, ধুলাই উন্নয়ন
আড়ষ্ট শীত শেষের হাওয়া বইছে। দুয়ার থেকে কিছু দূরে দাঁড়িয়ে বসন্ত। ভালো করে তাকালেই দেখতে পাওয়ার কথা। এই তো আর কটা দিন। মাঘের পরই তো ফাল্গুন। সেই মতে কোনো ঝামেলা ছাড়াই ক্যালেন্ডার মেনে বসন্ত আসবার কথা। এবারের আড়ষ্ট শীত নিজের ব্যাটনটি তার হাতে তুলে দিতে পারলেই যেন বাঁচে। কে না জানে এ এক রিলে রেস। প্রকৃতি জানান দিক আর না দিক, নিয়মমতো ঋতু বদলাবে, আর মানুষেরা তাকে বরণ করতে করবে নানা আয়োজন। যেন একটা অনুষ্ঠান, নির্ধারিত শিল্পীর অনুপস্থিতিতেও যা থামবে না। আর তাই শহুরে লোকেরা নিয়ম মেনে ঢুকে পড়ে নিজ নিজ সামর্থ্য মেনে বিপণিবিতানে। কেনে ঋতুধর্মী পরিচ্ছদ। বিভিন্ন মাধ্যম দিতে থাকে নির্ধারিত উৎসব উদ্যাপনের নানা রেসিপি।
বসন্ত দুয়ারে প্রায়। আর তো মাত্র কটা দিন। মৃদু বাতাসের অপেক্ষা, যা নিয়ে আসবে ফুলের গন্ধ, দূরবর্তী পাখির ডাক। এ এক চিরাচরিত অভ্যাস, যা অতীত ও রচিত শব্দসম্ভার আমাদের মগজে ঢুকিয়ে দিয়েছে। সবুজ ও জলজ পরিসর অতীত হলেও অভ্যাসটি অতীত হয়নি। আর এখানেই সংকট। কারণ, অন্তত ঢাকাবাসীর এই অভ্যাসকে প্রশ্রয় দেওয়ার সুযোগ নেই। কারণ—ধুলা। বসন্তের আগমনী হাওয়ায় বুকভরে শ্বাস নেওয়াটা এখানে দীর্ঘশ্বাসে পরিণত হতে পারে। কারণ—ধুলা। শ্বাস নিলে ফুল নয়, ধুলার গন্ধটিই পাওয়া যাবে, পাওয়া যায়। বড় একঘেয়ে।
ঢাকার সব রাস্তা, সব এলাকা একযোগে এই ধুলার জোগান দিচ্ছে। এ এক দারুণ ঐক্য। শ্রেণীকরণ করা যেতে পারে অবশ্য। এই যেমন মেট্রোরেলের ধুলা, ওয়াসার সরবরাহ লাইনের ধুলা, সড়ক সংকোচন-প্রসারণের ধুলা, উঁচু দালানের ধুলা ইত্যাদি এবং ইত্যাদি। এই শহর, এই কংক্রিট জঙ্গল ধুলার এক দারুণ উৎপাদন ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। রাস্তার ধারের দোকানে চা খাওয়ার সময় চিনি কম-বেশি ইত্যাদি বলে নানা ফরমাশ দেওয়া যেতেই পারে, কিন্তু ধুলা না দেওয়ার ফরমাশ দিলে তা টিকবে না নিশ্চিত। পানের সঙ্গে দেওয়া চুনের গায়ে লেপ্টে থাকছে ধুলা, যেন কত যুগ-যুগান্তের সখ্য তাদের। অবশ্য দুই–ই তো খনিজ।
ঢাকার ধুলা বেশ দামি কিন্তু। এ ধুলায় সিসা, ক্যাডমিয়াম, দস্তা, ক্রোমিয়াম, নিকেল, আর্সেনিক, ম্যাঙ্গানিজ ও কপারের মতো ধাতু জানান দিচ্ছে নিজের অস্তিত্ব। তা–ও আবার যেনতেন মাত্রায় নয়। একেবারে সর্বোচ্চ মাত্রায়। এর মধ্যে মাটিতে যে মাত্রায় ক্যাডমিয়াম থাকার কথা, ঢাকার ধুলায় তার চেয়ে প্রায় ২০০ গুণ বেশি পাওয়া গেছে। আর নিকেল ও সিসার মাত্রা দ্বিগুণের বেশি। এই যখন অবস্থা, তখন আর্সেনিক ভাবল, বহুকাল তো হলো জল-ডাঙায় থেকেই কুমিরচোখে চোখ রাঙালাম, এইবার দেখা যাক ধুলার জীবন। ধুলায় আশ্রয় নিয়ে আর্সেনিকও তাই অনায়াসে দিচ্ছে হাওয়ায় উড়াল। আর এই দিকে রবীন্দ্রনাথের ভুলভাল পাঠ নিয়ে নগরবাসী নাক-মুখ ঢেকেই নাভিশ্বাস তুলতে তুলতে বলছে যেন, ‘তোমার শঙ্খ ধুলায় প’ড়ে/ কেমন করে সইব/ বাতাস আলো গেল মরে/ এ কী রে দুর্দৈব।’
দুর্দৈব সত্য। কিন্তু ওই যুদ্ধের শঙ্খ না বাজবার জন্য নয়, বরং বাজবার জন্যই। ঢাকায় ধুলার ডানায় মূল শক্তি ও রসদটি জোগাচ্ছে উন্নয়নের বিজয়কেতন। শঙ্খ বাজিয়ে, মানে প্রকল্প, আনুষ্ঠানিকতা ও তীব্র করতালির মধ্য দিয়েই এই উন্নয়ন সূচিত হয়েছে। কিন্তু বাতাস আলোকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাবার কোনো চেষ্টা নেই। এই দিকে জেরবার মানুষ। ঢাকার ধুলায় থাকা ভারী ধাতুকণার আকার এতটাই সূক্ষ্ম যে তা মানুষের চুলের চেয়ে ২৫ থেকে ১০০ গুণের বেশি ছোট। ফলে খুব সহজেই এসব সূক্ষ্ম ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তুকণা ত্বকের সংস্পর্শে আসছে। শ্বাসপ্রশ্বাস, খাদ্য ও পানীয়র মাধ্যমে ঢুকে পড়ছে শরীরেও। দুর্দৈব এতটাই যে এয়ার ভিজ্যুয়ালের হিসাবমতে, গত ১৯ ও ২০ জানুয়ারি বাংলাদেশ সময় রাত ১১টার দিকে বিশ্বে সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহরের তালিকায় ঢাকা ছিল এক নম্বরে। দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল নয়াদিল্লি। সে যা–ই হোক, এক নম্বর তো হওয়া গেল।
শুষ্ক মৌসুমে অবকাঠামো উন্নয়নের কারণে এমন পরিস্থিতি হতেই পারে। লোকেদের শ্বাস বাঁচাতে উন্নয়ন থামাতে হবে, এমন কথাও অবান্তর। কিন্তু সহনীয় তো করা যায়। পানি ছিটিয়ে, পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিয়ে। না, সে রকম কেউ নিচ্ছে না। বরং কথাটি তুললেই এ দেখাচ্ছে তাকে, তো সে একে। আর সাধারণ মানুষ এই সবের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে সঞ্চিত পানিটুকু ঢেলে দিচ্ছে রাস্তায়, কিছুটা নিষ্কৃতির প্রত্যাশায়। কিন্তু ওই নিষ্কৃতি মুহূর্তের কেবল। পড়ে থাকা ধুলার শরীর শুষে নিচ্ছে, ডানা পাওয়া ধুলা এসে ঢেকে দিচ্ছে সে পানি। ফলাফল ধুলাই জীবন। তাই মানুষ থামছে না। থামতে মানা। ‘ধুম-উন্নয়ন/ অগ্রগতি-অঙ্কিত সড়কপথে যেতে হবে দূর থেকে বহুদূর পার।’ এই বাক্য মেনেই ছুটছে, ওড়াচ্ছে ধুলা।
শুধু ধুলাই নয়, আছে ধোঁয়াও। এ দুইয়ের মেলবন্ধনে মোড়ে মোড়ে স্থিরচিত্রের মতো দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িসকলও যেন খকখক কাশিতে জানান দিচ্ছে তার যন্ত্রণা। আর এই শব্দ ঢুকে যাচ্ছে কান থেকে মাথায়, মাথা থেকে জীবনে। শব্দের দারুণ এক সমুদ্র, যেখানে মানুষেরা যাপন করছে এক নিঃশব্দ জীবন। এখানেই শেষ নয়। আছে কিছুটা আর্দ্র কিন্তু পূতিগন্ধময় ডাস্টবিন-সকল। মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে দিচ্ছে অভিবাদন। রইল বাকি ঘর। কিন্তু আদতে কি বাকি? না, সেখানেও বাইরের ওই ধুলা–ধোঁয়ায় পূর্ণ বাতাস ও তার দূষণের ৪২ শতাংশ ঢুকে পড়ছে। ঢাকা যেন তার সমস্ত জঞ্জাল উগরে দিয়েছে। সমস্ত যন্ত্রণা মূর্ত করে যেন বলতে চাইছে কিছু। কেউ শুনছে না তার কথা। ধুলো আর ধোঁয়ায় ঢাকা আকাশের নিচে আরও ধূলিময় পথের ওপর দিয়ে মাথা নত করে হাঁটছে মানুষ। গুনে গুনে শ্বাস নিচ্ছে, আর হাঁটছে। কোথায় যাচ্ছে জানে না। কেউ জানে না। মাথার ওপর, চোখের সামনে, চারপাশে একমাত্র ভাবুক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দালানেরা। তারা বাড়ছে তো বাড়ছেই। পথগুলো ডানা পেতে উদ্গ্রীব।
এলিভেটেড থেকে ফ্লাই, ফ্লাই থেকে মেট্রো—সব পথ উড়ে যাবে সে ডানায়। আর নিচ দিয়ে মাথা নিচু করে হাঁটবে ডানা-ছাঁটা মানুষেরা। নিরুপায় মানুষেরা। প্রকল্পের মানুষেরা, যারা আসছে বসন্তেও ফুলের সুবাস খুঁজবে বাতাসে অভ্যাসে। অথচ পাবে শুধু ধুলাপূর্ণ শ্বাস ও হৃদয়। আর শিশুরা তাদের ছোট হতে থাকা ফুসফুস নিয়ে বসে থাকবে মন খারাপ করে। তাদের ঘন শ্বাসের কাছে এসে নত হয়ে যাবে সময়। কাউকে দুষবে কি তারা? দুষলেই–বা কী! সিটি করপোরেশন থেকে ওয়াসা, ওয়াসা থেকে নগরের আর ব্যবস্থাপকেরা শুধু দারুণ দক্ষতায় বলে যাবে, ‘বিবেচনায় তো ছিল, কিন্তু কাজ হচ্ছে না।’ বসন্ত উদ্যাপনের মতোই নিয়ম মেনে এ তাকে দেখাবে, তো সে একে। আর সাধারণ বিড়বিড় করে আওড়াবে শুধু, ‘ধুলাই জীবন, ধুলাই উন্নয়ন। সুতরাং হে শিশু, এই ধুলায় শ্বাস নেওয়ার গভীর পাঠ নাও এইবার। এই হোক তোমার একমাত্র উদ্দীষ্ট। আর সব ফাঁকি; ধরে নাও কথার কথা।’
প্রিয় পাঠক, আপনিও হতে পারেন আওয়ার বাংলা অনলাইনের একজন সক্রিয় অনলাইন প্রতিনিধি। আপনার আশেপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনা, অপরাধ, সংবাদ নিয়ে লিখুন এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ছবিসহ মেইল করুনঃ [email protected] এই ঠিকানায়। লেখা আপনার নামে প্রকাশ করা হবে।