দলীয় বিপর্যয় – টার্গেট ঘুরে দাঁড়ানো
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পরাজয়ের পর দুঃসময় পার করছে বিএনপি। রাজনীতির মারপ্যাঁচে বারবার ধরাশায়ী দলটি সাংগঠনিকভাবেও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।
সর্বশেষ নির্বাচন ঘিরে মামলা ও গ্রেফতারে নাজেহাল দলের নেতাকর্মীরা।
দুঃসময়ে পাশে নেই বিএনপির দুই কাণ্ডারি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তাদের অনুপস্থিতিতে বর্তমান সংকট কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোই দলটির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও বিএনপির নেতাকর্মীরা মনে করেন, এই পরিস্থিতি উত্তরণে হাইকমান্ডকে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। দল পুনর্গঠন করে নেতাকর্মীদের মাঝে আস্থা ও মনোবল ফিরিয়ে আনতে সঠিক ও বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নিতে হবে।
সুবিধাবাদীদের বাদ দিয়ে যোগ্য ও ত্যাগীদের সামনে এনে দ্রুত দল পুনর্গঠনে হাত দেয়ার পরামর্শ দেন তারা। তাদের মতে, প্রতিষ্ঠার পর বিভিন্ন সময় বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে দলটি। কিন্তু বারবারই তারা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এবারও দলটি ঘুরে দাঁড়াবে বলে প্রত্যাশা তাদের।
জানতে চাইলে বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ যুগান্তরকে বলেন, বিএনপি এদেশের পুরনো একটি রাজনৈতিক দল। গৌরবোজ্জ্বল অতীত আছে এ দলের। নানা সময়ে দলটি বিপর্যয়ে পড়ে আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
সব পর্যায়ে যোগ্য ও ত্যাগীদের হাতে নেতৃত্ব তুলে দিতে হবে, ভাবতে হবে স্বাধীনতাবিরোধীদের সঙ্গ ছাড়ার বিষয়টিও …
একাদশ নির্বাচনের পর বিএনপি আবারও নতুন করে সংকটে পড়ছে এতে সন্দেহ নেই। তিনি বলেন, এ সংকট থেকে উত্তরণে বিএনপিকে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নিয়ে এগুতে হবে। সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করতে দ্রুত পুনর্গঠনের উদ্যোগ নিতে হবে। যোগ্য এবং ত্যাগীদের শীর্ষ নেতৃত্বে আনতে হবে। নতুন নেতৃত্বকে জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করতে হবে।
বিশ্লেষকদের মতে, প্রতিষ্ঠার তিন যুগ পরও সাংগঠনিকভাবে শক্ত ভীতের ওপর দাঁড়াতে পারেনি বিএনপি। বিগত সময়ে সরকারবিরোধী আন্দোলনে সাংগঠনিকভাবে নাজুক হয়ে পড়ে দলটি।
আন্দোলনে ব্যর্থতা এবং মামলার কারণে নেতাকর্মীদের মধ্যে সৃষ্টি হয় হতাশা। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে কারাগারে যাওয়ায় তারা আরও ভেঙ্গে পড়েন। চেয়ারপারসন কারাগারে যাওয়ায় দলের মূল নেতৃত্বের দুর্বলতা প্রকট আকার ধারণ করে। দলের দ্বিতীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি তারেক রহমান লন্ডনে বসে দল পরিচালনা করলেও তা সরাসরি ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারেনি।
তার সিদ্ধান্ত নিয়ে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা ছিল অন্ধকারে। সিনিয়র নেতারা ঐক্যবদ্ধভাবে দল পরিচালনা করলেও নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সেখানে কিছুটা দূরত্ব তৈরি হয়। সিনিয়ররা যার যার আসনে নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত থাকায় দলের চেইন অব কমান্ড অনেকটা ভেঙে পড়ে। তাই এখনই দলের নেতৃত্ব শক্তিশালী করার ওপর জোর দিতে হবে। ঐক্যবদ্ধ নেতৃত্বের প্রতি তৃণমূলের আস্থা ও বিশ্বাস আনাও এই মুহূর্তে বড় চালেঞ্জ।
ত্যাগী ও যোগ্যদের মূল্যায়নের সময় এসেছে বলে মনে করছেন নেতাকর্মীরা। তৃণমূলই বিএনপির মূল ভরসার জায়গা। কিন্তু সেই তৃণমূলও এখন নানা কারণে বিপর্যস্ত। মামলার বোঝা মাথায় নিয়ে তৃণমূলের হাজারও নেতাকর্মী যাযাবর জীবন-যাপন করছে।
নির্যাতন এবং মামলার ভয়ে অনেকেই এলাকায় যান না। এছাড়া ক্ষমতায় থাকাকালে সুবিধাবাদী নেতারা বিভিন্ন কমিটিতে শীর্ষ পদগুলো দখল করে নানা অনিয়ম করে। কিন্তু দলের দুঃসময়ে তারা নিজেদের গা বাঁচাতে দলীয় কর্মকাণ্ড ছেড়ে নিজ নিজ ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন।
আবার নির্বাচনের সময় ঠিকই মনোনয়ন বাগিয়ে নিয়েছেন। দলের এ সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারেনি ত্যাগী ও যোগ্য নেতাকর্মীরা। এ পরিস্থিতিতে সুবধিাবাদীদের বাদ দিয়ে যোগ্য ও ত্যাগীদের সামনে এনে নেতৃত্ব দিতে হবে।
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, স্বাধীনতার পক্ষের এ দলটি যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে জোট করায় রাজনৈতিকভাবে অনেকটা পিছিয়ে পড়েছে। যেকোনো চ্যালেঞ্জের সময় প্রতিপক্ষরা বারবার জামায়াতকে সামনে এনে বিএনপিকে ধরাশায়ী করেছে।
দেশের বড় একটি অংশও বিএনপির এ কৌশলকে পছন্দ করছেন না। তাই এখন সময় এসেছে দলটিকে কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়ার। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে ত্যাগ করে দলটিকে আপন শক্তিতে বলিয়ান হতে হবে। তাহলে দেশের সুশীল সমাজসহ বড় একটি অংশের সমর্থন পাবে বিএনপি।
টানা ক্ষমতার বাইরে থাকায় হতাশ হয়ে পড়েছে দলটির নেতা-কর্মীরা। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, তারেক রহমানসহ দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া শত শত মামলা।
সব মিলিয়ে দলের ভবিষ্যৎ প্রশ্নে নেতাকর্মীরা ছন্নছাড়া হয়ে পড়েছে। একসময়ে আন্দোলন-সংগ্রামে বিএনপির মূল শক্তি ছিল ছাত্রদল ও যুবদল। যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে বিএনপির ‘ভ্যানগার্ড’ খ্যাত সেই ছাত্রদল এখন নির্জীব।
অন্যদিকে যুবদল কার্যকারিতা হারিয়েছে অনেক আগেই। নেতৃত্ব কোন্দলে ত্রাহি অবস্থা সংগঠনটির। আন্দোলন-সংগ্রামে দলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শাখা ঢাকা মহানগর। ব্যর্থতার অভিযোগে সাদেক হোসেন খোকাকে সরিয়ে মির্জা আব্বাস ও হাবিব-উন-নবী খান সোহেলের নেতৃত্বে কমিটি আনা হলেও তারা কার্যকর কিছু দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন। এরপর ঢাকাকে দুই ভাগ করে নতুন কমিটি ঘোষণা করা হলেও ঘুরে দাঁড়াতে ব্যর্থ হয়।
কেন্দ্রীয় কমিটিতেও অনেক পদ ফাঁকা। অঙ্গসংগঠনগুলো দীর্ঘদিন ধরে একই নেতৃত্বে ঘুরপাক খাচ্ছে। সময় এসেছে এসব পরিবর্তনের। যোগ্য নেতৃত্বের হাতে অঙ্গসংগঠনগুলোর দায়িত্ব তুলে দিতে হবে।
জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যুগান্তরকে বলেন, দেশের জনপ্রিয় একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি। এই দলটিকে নিশ্চিহ্ন করতে সরকার নানা কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে। হামলা-মামলা ও গ্রেফতারের মাধ্যমে নেতাকর্মীদের চরমভাবে নির্যাতন ও হয়রানি করা হচ্ছে।
সর্বশেষ তামাশা ও প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে নেতাকর্মী ও সমর্থকদের মনোবল ভেঙে দেয়ার চেষ্টা করছে।
কিন্তু প্রতিষ্ঠার পর অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আবার স্বমহিমায় ঘুরে দাঁড়িয়েছে বিএনপি। তাই সরকার যতই কৌশল গ্রহণ করুক এ দলটিকে ধ্বংস বা নিশ্চিহ্ন করা যাবে না।
প্রিয় পাঠক, আপনিও হতে পারেন আওয়ার বাংলা অনলাইনের একজন সক্রিয় অনলাইন প্রতিনিধি। আপনার আশেপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনা, অপরাধ, সংবাদ নিয়ে লিখুন এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ছবিসহ মেইল করুনঃ [email protected] এই ঠিকানায়। লেখা আপনার নামে প্রকাশ করা হবে।