পুরনো ছক বদলে জঙ্গিরা নতুন কৌশলে
পুরনো সব কৌশল আমূল বদলে নতুনভাবে সংগঠন গোছাচ্ছে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলাম (পূর্বের আনসারুল্লাহ বাংলা টিম-এবিটি)। টার্গেট করার ক্ষেত্রেও দীর্ঘ দিনের ছক বদলানোর নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংগঠনটি। আগে যেখানে টার্গেট ছিল ব্যক্তি; এখন সেখানে জঙ্গিদের কাছে অগ্রাধিকার পাচ্ছে প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক হামলা। গ্রেফতার এড়াতে কোনো মেস বা বাসাবাড়িতে একসঙ্গে দু’জনের বেশি অবস্থান করছে না তারা। সংগঠনের নতুন সদস্য রিক্রুটমেন্টের ক্ষেত্রে তারা অগ্রাধিকার দিচ্ছে মাদ্রাসাছাত্রদের।
রাজধানীর কলাবাগানে চাঞ্চল্যকর জুলহাজ মান্নান ও মাহবুব তনয় হত্যায় সরাসরি অংশ নেওয়া দুর্ধর্ষ জঙ্গি আসাদুল্লাহকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এসব তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা। তাকে তিন দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে মামলার তদন্ত সংস্থা কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি)। সংশ্নিষ্ট উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বলছেন, নিজেদের ভেঙে পড়া নেটওয়ার্ক জোড়াতালি দেওয়ার নতুন এই কৌশলে বা তাদের নিজেদের ভাষায় ‘দ্বিতীয় ধাপে’ নিয়ে আবারও সংঘবদ্ধ হয়ে এগোতে চাইছে জঙ্গিরা।
এ ব্যাপারে সিটিটিসির ডিসি মুহিবুল ইসলাম খান আওয়ার বাংলাকে বলেন, জঙ্গিদের নতুন নতুন কৌশল থাকলেও পুলিশ পাল্টা কৌশল নিয়ে তাদের প্রতিরোধের সক্ষমতা রাখে। নিবিড় তদারকির কারণে উগ্রপন্থিরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারছে না। অনলাইনে মনিটরিংয়ের জন্যও রয়েছে পৃথক টিম।
১০ বছরের বেশি সময় ধরে জঙ্গি কার্যক্রমের ওপর নজর রাখছেন, এমন এক কর্মকর্তা আওয়ার বাংলাকে জানান, আনসার আল ইসলাম এখন তাদের সংগঠনের জন্য নতুনভাবে রিক্রুট করছে অনলাইনে দাওয়াতের মাধ্যমে। দলভুক্ত হওয়ার ব্যাপারে কেউ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলে তার পরীক্ষা নেওয়া হয় অনলাইনেই। ‘হিজরত’ও করানো হয় একই প্রক্রিয়ায়। এ পর্যায় সম্পন্ন করার মধ্য দিয়ে রিক্রুট করা ব্যক্তি উগ্রপন্থি হিসেবে সংগঠনের স্বার্থে নিজেকে উৎসর্গ করার উপযোগী হয়ে ওঠে। ২০১৭ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত আসাদুল্লাহ ১৫ জনকে আনসার আল ইসলামে রিক্রুট করেছে। টার্গেট ব্যক্তিকে কুপিয়ে হত্যা করার প্রশিক্ষণও তাদের দিয়েছে আসাদুল্লাহ। তাদের ভাষায়, এটি ‘আসকারি’ ট্রেনিং।
গুলশানে ২০১৬ সালে হলি আর্টিসানে হামলার আগে-পরে তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, তখন পুরনো জেএমবি, নব্য জেএমবি ও আনসার আল ইসলামে রিক্রুট করা হতো দেশে-বিদেশে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করা মেধাবী শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন কারিকুলামের ছাত্রছাত্রীদের মধ্য থেকে। হঠাৎ আবার রিক্রুটমেন্টের ক্ষেত্রে মাদ্রাসাছাত্রদের প্রাধান্য দেওয়ার কারণ সম্পর্কে আসাদুল্লাহ জানায়, অধিকাংশ মাদ্রাসা শিক্ষার্থীর সঙ্গেই পরিবারের সদস্যদের যোগাযোগ ‘আলগা’ থাকে। অনেকে মোবাইল ফোনও ব্যবহার করে না। তাই দলে অন্তর্ভুক্ত করে তাদের মোটিভেশনাল প্রশিক্ষণ দিয়েই দ্রুত সংগঠনের কাজে লাগানো যায়।
দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, দীর্ঘ দিন ধরেই আনসার আল ইসলামের সদস্যরা ছোট ছোট সেলে বিভক্ত হয়ে কাজ করছে। এদের প্রত্যেক সদস্যেরই একাধিক ছদ্মনাম রয়েছে। একেকটি সেলে ৪-৮ জন সদস্য থাকতে পারে। এর আগে তারা কোনো মেস বা বাসায় একত্রিত হয়ে বসবাস করলেও এখন আর কোনো বাসায় দুইজনের বেশি অবস্থান করছে না। যদিও সাংগঠনিক কাজের জন্য তাদের সেলভিত্তিক পরিচয় রয়েছে।
সূত্র জানায়, আনসার আল ইসলামের সদস্যরা ছদ্মবেশে নানা ধরনের পেশায় জড়িয়ে পড়েছে। আসাদুল্লাহ দীর্ঘ দিন মোবাইল ফোনের কভার বিক্রি করেছে। তার সহযোগীদের কেউ সাইকেল-রিকশার মেকানিক, কেউ ঝালমুড়ি ও মধু বিক্রেতা, কেউ আবার রিকশাচালক সেজেছে। কেউ আনসার আল ইসলামে যোগ দিলে তাকে সংগঠন থেকে মাসে তিন হাজার টাকা দেওয়া হয়। আর কেউ পরিবার নিয়ে বসবাস করলে তাকে দেওয়া হয় আট হাজার টাকা। সদস্যদের মাসিক চাঁদা ছাড়াও দেশি-বিদেশি বেশ কিছু ডোনার রয়েছে আনসার আল ইসলামের। সংগঠনটির সদস্যদের মধ্যে এখনও প্রতি মাসে সাড়ে তিন লাখ টাকা বিতরণ করার তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা।
জঙ্গি আসাদুল্লাহ ২০১৫ সালে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু শহীদুল্লাহর হাত ধরে আনসার আল ইসলামের সদস্য হয়। বর্তমানে পলাতক শহীদুল্লাহ পড়াশোনা করত যশোর পলিটেকনিকের ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে। আসাদুল্লাহ একই প্রতিষ্ঠানে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র ছিল। ধরা পড়ার আগে চার বছর আসাদুল্লাহ পালিয়ে ছিল। ২০১৭ সালে সে এক সহযোগী জঙ্গির বোনকে বিয়ে করে। সর্বশেষ টঙ্গী স্টেশন রোডের ভাড়া বাসায় তিন মাস বয়সী সন্তান ও স্ত্রীসহ বসবাস করছিল আনসার আল ইসলামের সামরিক শাখার প্রশিক্ষক আসাদুল্লাহ। তার সঙ্গে সংগঠনের শীর্ষ নেতা মেজর (বরখাস্ত) জিয়ার যোগাযোগও ছিল। বিশেষ অ্যাপসের মাধ্যমে সর্বশেষ গত ৬ জানুয়ারি জিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ হয় তার।
আসাদুল্লাহর গ্রামের বাড়ি ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার মদনপুর এলাকায়। তার বাবা এমদাদুল হক চুয়াডাঙ্গার মাধবপুর ইসলামিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করতেন। তিনি স্থানীয় জামায়াতে ইসলামীর রুকন ছিলেন। আসাদুল্লাহর ছয় ভাইয়ের সবাই শিবিরের সাথী। তার দুই বোনের বিয়ে হয়েছে শিবির নেতাদের সঙ্গে। তার ভাই শিবিরের সাথী খলিলকে নারায়ণগঞ্জ থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ২০১৬ সালের ১৯ জানুয়ারি উত্তর বাড্ডার সাতারকুলে পুলিশ পরিদর্শক বাহাউদ্দিন ফারুকীর ওপর হামলা চালিয়ে অস্ত্র ছিনিয়ে নেয় আনসার আল ইসলাম। একই বছর রাজধানীর কলাবাগানে চাঞ্চল্যকর জুলহাজ-তনয় হত্যা মিশনে পুলিশের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া ওই অস্ত্র ব্যবহার করে জঙ্গিরা। ঘটনার সময় পুলিশের ওই অস্ত্র থেকে এক রাউন্ড গুলি করে এবিটির সদস্যরা। অস্ত্রটি পরে আসাদুল্লাহর হেফাজতে ছিল। দীর্ঘ দুই বছর পর গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে আসাদুল্লাহর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে টঙ্গি থেকে সে অস্ত্র উদ্ধার করে পুলিশ।
আসাদুল্লাহর বাবা এমদাদুল হক আওয়ার বাংলাকে বলেন, ২০১৪ সালে যশোর থেকে আসাদুল্লাহ ফোন করে। তখন সে একবারে চলে যাওয়ার কথা জানিয়েছিল। বলেছিল, তার কোনো খোঁজ নেওয়ার দরকার নেই। আসাদুল্লাহ শিবিরের সঙ্গে জড়িত ছিল। পরে সে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ে। তবে এসব তাদের জানা ছিল না। বাড়ি ছাড়ার পর তার খোঁজ চেয়ে জিডিও করেননি তিনি।
পুলিশ জানায়, আনসার আল ইসলামের ছয় সদস্যের শুরা টিম রয়েছে। এরই মধ্যে এই টিমের দু’জন ধরা পড়েছে। তারা হলো- শেখ আব্দুল্লাহ ওরফে জোবায়ের ও মোজাম্মেল হোসেন ওরফে সায়মন। অন্য চার শুরা সদস্যকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। দলটির করা প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক একটি টার্গেট লিস্ট সম্পর্কেও তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা।
সাবেক এবিটির তিন সদস্যের একটি অপারেশনাল ‘কোর কমিটি’ রয়েছে, যেটির প্রধান ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানের ঘটনায় চাকরিচ্যুত পলাতক মেজর জিয়া। ব্লগার রাজীব, অভিজিৎ, প্রকাশক দীপন, ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান, নীলাদ্রী, জবি ছাত্র নাজিমুদ্দিন, জুলহাজ-তনয় খুন ও মিরপুরে স্কুল শিক্ষক হত্যাচেষ্টাসহ বেশ কিছু ঘটনায় জড়িত ছিল এবিটি। বিভিন্ন সময় রাজধানীর সাতারকুল, মোহাম্মদপুরসহ বিভিন্ন স্থানে এবিটির আস্তানায় অভিযান চালালেও গ্রেফতার করা যায়নি শীর্ষ নেতা জিয়াকে। যদিও কম্পিউটার, ল্যাপটপসহ নানা আলামত জব্দ করা হয়। এখন জিয়াকে গ্রেফতারই বড় চ্যালেঞ্জ। সর্বশেষ ২০১৮ সালের ১১ জুন মুন্সীগঞ্জের সিরাজদীখানের পূর্ব কাকালদী এলাকায় লেখক-প্রকাশক শাহজাহান বাচ্চু হত্যায় জড়িত ছিল আনসার আল ইসলাম। ওই অপারেশনে প্রথমবারের মতো যৌথভাবে আনসার আল ইসলাম ও পুরনো জেএমবির সদস্যরা অংশ নেয়।
পুলিশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, ব্যক্তি হত্যার টার্গেট থেকে পুরোপুরি সরে আসেনি আনসার আল ইসলাম। তবে তারা মনে করছে, এ ধরনের অপারেশন করতে গিয়ে তাদের সংগঠন বেশি ‘ক্ষতিগ্রস্ত’ হয়ে কম ‘লাভবান’ হয়েছে। তাই তারা প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক হামলার টার্গেট নিয়ে এগোচ্ছে। তবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের তৎপরতায় যে কোনো জঙ্গি হামলার পরিকল্পনা নসাৎ করে দেওয়া সম্ভব বলে মনে করেন তিনি। দেশে আপাতত বড় ধরনের হামলা করার সক্ষমতা উগ্রপন্থিদের নেই বলে বিশ্বাস সংশ্নিষ্ট সবার।
প্রিয় পাঠক, আপনিও হতে পারেন আওয়ার বাংলা অনলাইনের একজন সক্রিয় অনলাইন প্রতিনিধি। আপনার আশেপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনা, অপরাধ, সংবাদ নিয়ে লিখুন এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ছবিসহ মেইল করুনঃ [email protected] এই ঠিকানায়। লেখা আপনার নামে প্রকাশ করা হবে।