৩০২৫ পত্রিকার দেশে অনলাইন কেন মাথাব্যথা!
গত ১৫ বছরে অনলাইন সংবাদপত্র দেশে একটি শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের আগ্রাসনের সঙ্গে সঙ্গে অনলাইন সংবাদ মাধ্যমও আবির্ভূত হয়েছে এক অপরিহার্য অংশ হিসেবে। ফলে দৈনিক সংবাদপত্রগুলো যেমন তাদের অনলাইন সংস্করণ প্রকাশ করতে বাধ্য হয়েছেন, তেমনি টেলিভিশনগুলোও সার্বক্ষণিক আপডেট থাকছে অনলাইনে। প্রতি মুহূর্তে ঘটে যাওয়া যে সংবাদ আপনি এখন পড়ছেন তা পরদিন থাকছে প্রিন্টে। বাড়তি অর্থ ব্যয় করে সকালে আপনাকে পড়তে হচ্ছে একদিন আগের বাসি খবর। পাঠক হিসেবে আমি তাৎক্ষণিকভাবে প্রিন্টের অনলাইন ভার্সন পড়ব, নাকি অপেক্ষা করব পরদিন সকালে বাসি হিসেবে পড়তে?
অনলাইন গণমাধ্যমের এই প্রসার মেনে নিতে পারছেন না সনাতনধর্মী চিন্তার প্রশাসন, গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলো বা সাংবাদিকেরা। আমরা জানি, গণমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা নির্ভর করে তার কনটেন্ট এবং বস্তুনিষ্ঠতার ওপর। সেটি অনলাইন বা কাগজের দৈনিক অথবা টেলিভিশন বা রেডিওর মাধ্যমে প্রচারের ওপর নির্ভর করে না।
এখন দেশে অসংখ্য অনলাইন গণমাধ্যম রয়েছে। হাতেগোনা কয়েকটি বাদে সবগুলোই দুই-একজনের প্রয়াস। কোনো ভিত্তি না থাকলেও লোকমুখে একটি গুঞ্জন রয়েছে দেশে অনলাইনের সংখ্যা ১০ হাজার। তবে যখন নিবন্ধনের জন্যে আবেদন চাওয়া হলে জানুয়ারি ২০১৮ পর্যন্ত সরকারের নিবন্ধনের জন্যে ২ হাজার ১৮টি অনলাইন গণমাধ্যম আবেদন করেছে। এর মধ্যে সরকার যে দিকগুলো বিবেচনা করে নিবন্ধন দেয়ার কথা বলেছে, সেগুলোকে অনেকেই যুক্তিযুক্ত মনে করছেন না। কারণ ট্রেড লাইসেন্স বা চারিত্রিক সনদপত্রের সঙ্গে একটি গণমাধ্যমের কাঠামোগত দিকটিরও গুরুত্ব রয়েছে। একটি গণমাধ্যমে কতজন সাংবাদিক রয়েছেন, কতটুকু জায়গা নিয়ে কর্মস্থল বা পাঠক সংখ্যা এবং বিশ্বাসযোগ্যতার ওপর নির্ভর করেই নিবন্ধন দেয়ার কথা বলা হচ্ছে। তবে সর্বোপরি পাঠকের ওপর ছেড়ে দেয়াকেই গুরুত্ব দিচ্ছেন গণমাধ্যম সংশ্লিষ্টরা।
অনেকেই হয়তো ২ হাজার ১৮টি অনলাইন সংবাদ মাধ্যমের নিবন্ধনের আবেদনের কথা শুনে চমকে উঠেছেন। আবার অনলাইন গণমাধ্যমের গুষ্ঠি উদ্ধার করতে প্রস্তুত হচ্ছেন। তাদের জন্যে বলি, দেশে কাগজের সংবাদপত্রের সংখ্যা কি জানেন?
২০১৮ সালের ১১ জানুয়ারি সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর জাতীয় সংসদে দেয়া তথ্য অনুযায়ী সারাদেশে এখন নিবন্ধিত পত্রিকার (প্রিন্ট মিডিয়া) সংখ্যা ৩ হাজার ২৫টি। এর মধ্যে দৈনিক পত্রিকার সংখ্যাই ১ হাজার ১৯১টি। দৈনিক পত্রিকাগুলোর মধ্যে ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয় ৪৭০টি। অর্ধসাপ্তাহিক পত্রিকা তিনটি, সাপ্তাহিক পত্রিকা ১ হাজার ১৭৫টি, পাক্ষিক ২১২টি, মাসিক ৪০৪টি, দ্বিমাসিক ৭টি, ত্রৈমাসিক ২৮টি, চতুর্মাসিক ১টি, ষাণ্মাসিক ২টি এবং বার্ষিক পত্রিকা ২টি। প্রিন্টের সার্কুলেশনের খবর কি একজন পাঠক রাখছেন? সার্কুলেশন সংখ্যা যে ‘শুভংকরের ফাঁকি’-এটাও অনেকের জানা নেই। সরকারি বিজ্ঞাপন রেট বাড়ানোর জন্য বিরাট কারচুপির আশ্রয় নিচ্ছে কিছু কিছু দৈনিক। এ তথ্যগুলো অবশ্য গণমাধ্যমকর্মী বা সাংবাদিকদের জানা। বৃহত্তর পরিসরে সুষ্ঠু তদন্ত হলে বেরিয়ে আনতে পারে সঠিক তথ্য। এতে সাশ্রয় হতে পারে বিজ্ঞাপনের নামে সরকারে ব্যয় হওয়া বিপুল পরিমাণ অর্থও। বেতন বোর্ড রোয়েদাদ বাস্তবায়ন নিয়ে দুর্নীতি ও অনিয়মের সামান্য আভাষ দিয়েছে। সবিস্তারে পরে লেখার ইচ্ছে পোষণ করি।
সব মিলিয়ে দেশে কাগজের পত্রিকা রয়েছে ৬ হাজার ৫২০টি। কথা হলো এই সংখ্যার কাগজের দৈনিক কি আদৌ বের হয়, এই পত্রিকার মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটিকে বাদ দিলে আসলেই কি সংবাদপত্রের গুনগত মান সন্তোষজনক অবস্থায় রয়েছে! অবশ্যই নেই। শুধু যে হাজার হাজার দৈনিক পত্রিকার নিবন্ধন রয়েছে তাই নয়, গত ২ ডিসেম্বর ২০১৮ এর চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের তথ্যমতে ৬৬৭টি সংবাদপত্র সরকারি বিজ্ঞাপনের তালিকাভুক্তও রয়েছে।
অথচ এই দৈনিকগুলো নিয়ে কারো যেন চিন্তা নেই। সরকারের সর্বশেষ মজুরি রোয়েদাদ অনুযায়ী দৈনিক, দেশকাল, তৃতীয় মাত্রা, সোনালি খবর, সবুজ সংবাদ, অগ্রসর, মাতৃছায়া, শতকণ্ঠ, মতবাদ, নবযাত্রা, দৈনিক যুগের কথা, দৈনিক সিনসা, দৈনিক চাঁদনীবাজারের মতো ১০২ টি প্রতিষ্ঠান ৮ম ওয়েজবোর্ড বাস্তবায়ন করছে বলে জানানো হয়েছে। আসলে কি তা হচ্ছে! অথচ সাংবাদিকদের এই কাঠামোয় বেতন দেয়া হচ্ছে জানিয়ে সরকারি বিজ্ঞাপন নিচ্ছে সর্বোচ্চ মূল্যে। যারা পত্রিকাকে এখনো সর্বোচ্চ গুরুত্ব বিবেচনা করে থাকেন এবং অনলাইনে নাক সিটকান, তারা কি এই পত্রিকাগুলোর খবর রাখেন!
তবে অনলাইন নিয়ে এই দ্বিধা দ্বন্দ্ব কেন! বরং পাঠকের ওপরই ছেড়ে দেয়া হোক না, তারা কি পড়তে চান।
এতো গেলো কাগজের দৈনিকের হিসাব। এখন আসি টেলিভিশনের হিসেবে। দেশে এখন বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল রয়েছে ৪৫টি। এর মধ্যে কয়টি চ্যানেল মানুষ দেখছেন! কিছু চ্যানেল বিদেশি অনুষ্ঠানের বাংলা ডাবিং করে বা সিনেমা দেখিয়েই সময় কাটিয়ে যাচ্ছে।
টেলিভিশনগুলোর দর্শকও কমছে ভাটার পানির মতো। বাধ্যহয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং ইউটিউবে চলে যাচ্ছে তারাও। কারণ টিভি স্ক্রিনের সামনে বসে সময় পার করার অবস্থায় নেই মানুষ। বরং হাতের মোবাইলের স্ক্রিনেই খবর দেখতে বা পড়তে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন! আর যা প্রচারে এগিয়েই রয়েছে অনলাইন গণমাধ্যমগুলো।
তাই বলা হয় শত ফুল ফুটতে দাও। পুরো দুনিয়া জুড়েই অনলাইন সংবাদ মাধ্যমের একটি বিপ্লব ঘটে যাচ্ছে। অনেকেই স্বাবলম্বী হওয়ার জন্যে নিজেদের ব্লগ তৈরি করছেন। এসবের সঙ্গে অনলাইন সংবাদ মাধ্যমকে মিশিয়ে ফেললে হবে না। বরং পাঠকের ওপরই ছেড়ে দিতে হবে, তিনি সংবাদ মাধ্যম হিসেবে কোনটিকে বাছাই করবেন, কোনটিকে ব্লগ হিসেবে নেবেন বা কোন ধরনের অনলাইনকে বর্জন করবেন।